Tuesday, July 24, 2018

মুসলিম হওয়াটা কি আমার অপরাধ? প্রশ্ন ওজিলের


এমন কিছু যে হতে পারে, সেটা হয়তো অনেকের কল্পনাতেও ছিল না। মেসুত ওজিল নিজেও কি ভেবেছিলেন, চার বছরের ব্যবধানে দৃশ্যপট এভাবে বদলে যাবে, বদলে যাবে তার চারপাশটা? যে দেশের হয়ে তিনি বিশ্বকাপ জিতলেন, সোনালী ট্রফিটায় চুমু খেলেন, যে দেশের জার্সি গায়ে ফুটবল খেলেছেন, পরিচিতি পেয়েছেন, তারকা হয়েছেন, সেই দলটা থেকেই তাকে
এভাবে অবসর নিতে হবে!
কিন্ত কথায় আছে না, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন! ওজিলের বেলাতেও সেটাই ঘটেছে। ঘটনার সূত্রপাত বিশ্বকাপের আগে। ওজিল তখন নিজের ক্লাব আর্সেনালে খেলছেন। লণ্ডনে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। বলে রাখা ভালো, মেসুত ওজিল কিন্ত তুর্কী বংশোদ্ভুত জার্মান। ওজিলের বাবার বাড়ি ছিল তুরস্কে, ওজিলের জন্মও সেদেশেই। সেখান থেকে জার্মানীতে পাড়ি জমিয়েছিল তার পরিবার। তুরস্কের প্রতি ওজিলের টানটা তাই পুরনো, নিজের আরেকটা দেশ হিসেবেই তুরস্ককে জানেন এই মিডফিল্ডার। এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করে তাকে আর্সেনালের একটা জার্সি উপহার দিয়েছিলেন ওজিল। তার সঙ্গে ছিলেন আরেক তুর্কী বংশোদ্ভুত জার্মান ফুটবলার গুন্ডোয়ানও, তিনি খেলেন ম্যানচেস্টার সিটিতে।



সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরদোয়ানের সঙ্গে তোলা ছবি শেয়ার করেছিলেন ওজিল। তাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল জার্মান সমর্থকেরা। নিন্দা জানিয়েছিল কট্টরপন্থী জার্মান মিডিয়াও। তাদের ভাষ্য ছিল, তুরস্কের সঙ্গে জার্মানীর কূটনৈতিক সম্পর্ক মোটেই ভালো যাচ্ছে না। সেই সময়ে একজন জার্মান ফুটবল আইকন হয়ে ওজিল বা গুন্ডোগান কি করে সেদেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ‘একান্ত বৈঠক’ করেন, একসঙ্গে বসে ডিনার খান? তারা কি নিজেদের জার্মান ভাবেন না? নাকি তাদের কাছে জার্মান জাতীয়তার চাইতে তুর্কী পরিচয়টাই মূখ্য?
গুন্ডোগান সেযাত্রায় ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্ত প্রতিবাদ করেছিলেন ওজিল। তার কথা ছিল- “আমরা সেখানে একটা দাতব্য সংস্থার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। এটা একটা শিক্ষামূলক কর্মশালা ছিল, এবং যারা এখানে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের বেশিরভাগই ছিল শিশু। আমি তো কারো নির্বাচনী প্রচারণায় যাইনি, কারো জন্যে ভোট চাইনি। তাহলে আমাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? হ্যাঁ, আমি তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছি, ব্যাক্তি এরদোয়ানের সঙ্গে তো নয়। তার সঙ্গে তো অ্যাঞ্জেলা মার্কেলও বৈঠক করেন, থেরেসা মে’ও(বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী) আলোচনায় বসেন, তাদের দিকেও কি আপনারা অভিযোগের আঙুল ওঠাবেন?”



তবে তাতে শান্ত হয়নি জার্মান মিডিয়া বা সেদেশের কট্টরপন্থী ফুটবল ভক্তরা। তারা দাবী জানিয়েছিল, ওজিল বা গুন্ডোগানের মতো যারা জার্মান জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন না, তাদের যেন বিশ্বকাপের দলে নেয়া না হয়। কিন্ত সেসবে পাত্তা দেননি কোচ জোয়াকিম লো। দলের সেরা খেলোয়াড়দের একজনকে তো তিনি এমন অদ্ভুত কারণে বাদ দিতে পারেন না। সময়টা ওজিলের পক্ষে ছিল না, ফর্মটাও না। বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানী, ওজিল নিজেও ছিলেন ছায়া হয়ে। তাকে ঘিরে বিতর্ক তাই আরও বেড়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে হারের পর তো গ্যালারি থেকে এক জার্মান দর্শক নাকি ওজিলকে ‘তুর্কি শুয়োর’ বলে গালি দিয়েছিল! সেই দর্শকের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতিও বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন ওজিল।
ঘটনা এতদূর গড়াবে, সেটা হয়তো ওজিল নিজেও ভাবেননি। কিন্ত বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর থেকেই চারপাশটা অদ্ভুতরকমভাবে বদলে যেতে দেখলেন তিনি। জার্মানীতে তখন শুধু তার সমালোচনা। তিনটে বিশ্বকাপ খেলা ওজিলের আগের দুই বিশ্বকাপের কীর্তিগুলো লোকে ভুলে গেল, তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তুরস্কের মানুষ হিসেবে, যিনি জার্মান ছদ্মবেশে ফুটবল খেলছেন! পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছে, জার্সির একপাশে জার্মানীর সাদা রঙ, অন্যপাশে তুরস্কের লাল রঙ করা।

এই অস্থির সময়ে যাদের সমর্থন পাওয়াটা ওজিলের জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ছিল, সেই জার্মান ফুটবল ফেডারেশনও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তারাও যেন ওজিলের জার্মান অস্তিত্বটাকে অস্বীকার করতে শুরু করলো হঠাৎ করেই, যেন ওজিল নামে কেউ কখনও জার্মান দলের হয়ে খেলেনইনি! ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে পরোক্ষভাবে তাকেই বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়েছে। জার্মানীর হয়ে ৯২ ম্যাচ খেলা ওজিল তাতে যথেষ্ট আঘাত পেয়েছেন। তাই ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করতে দেরী করেননি, জানিয়ে দিয়েছেন, জার্মানীর জার্সিতে আর কখনও দেখা যাবে না তাকে!
বিশাল এক বার্তায় ওজিল জানিয়েছেন নিজের হতাশার কথা। তার এই সিদ্ধান্ত গ্রহনের পেছনে দায়ী করেছেন জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিদের। জার্মানীতে তিনি এখন বর্ণবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলেও টুইটারে দেয়া এক পোস্টে দাবী করেছেন ২৯ বছর বয়েসী ওজিল। তার মতে- “যখন আমরা বিশ্বকাপ জিতলাম তখন কেউ আমার জন্মস্থান নিয়ে মাথা ঘামায়নি, সবাই আমাকে জার্মান হিসেবেই মেনে নিয়েছে। আজ যখন আমি ভালো খেলতে পারছি না, অমনি আমাকে তুর্কি বানিয়ে দেয়া হলো? আমার সাথে এই বৈষম্যটার কারণ কি? আমি মুসলমান বলে? নাকি আমার জন্ম তুরস্কে বলে? এই দুটো ঘটনার কোনটাতেই তো আমার হাত ছিল না! অথচ এই দুটোই মনে হয় প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন!”



ওজিল বলেছেন- “তুরস্ক আমার জন্মস্থান, এটা জেনেই আমি বড় হয়েছি। আমার বাবা মা আমাকে এখানে বড় করেছেন, আমি জার্মান হিসেবেই বেড়ে উঠেছি, কিন্ত সেজন্যে তো আমি আমার শেকড়কে ভুলে যেতে পারবো না। জার্মানীর জার্সিটা গায়ে জড়ানোর সময় আমার ভীষণ গর্ব হতো, আজ থেকে সেটা আর হবে না। যে দেশটায় আমাকে জন্মস্থানের কারণে এত অপমানিত হতে হলো, যে দেশের ফুটবল ফেডারেশনে কিছু বর্ণবাদী মানুষ উঁচু পদগুলোতে বসে আছেন, সেদেশের জার্সিটা গায়ে দিতেও আমার রুচিতে বাধবে।”

ওজিলের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তারই কয়েকজন সতীর্থ। আবার জার্মানরাও ব্যাঙ্গ করতে ছাড়ছেন না। বায়ার্ন মিউনিখের সভাপতি উলি হোয়েনেস যেমন বলেছেন- “আমি খুশী যে ওজিল বিদায় বলেছে। ঘটনাটা এখানেই শেষ হওয়া দরকার। কয়েক বছর ধরেই সে জঘন্য খেলছিল, জার্মানীর মতো দলে তার জায়গা হবার কথা নয়। সে তো এখন তার বাজে পারফরম্যান্সগুলো এরদোয়ানের ছবি আর তুর্কি-মুসলমান ইস্যুর পেছনে লুকিয়ে ফেলছে।”



ঘটনাটা আপাতদৃষ্টিতে সামান্য লাগতে পারে অনেকের কাছে। তবে প্রবল জাতীয়তাবাদী বোধের জার্মানদের কাছে এরদোয়ানের সঙ্গে ওজিলের ছবি তোলা বা সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করাটা বিশাল অপরাধেরই শামিল। জাতীয়তায় জার্মান না হলে ব্যাপারটা ঠিকঠাকভাবে বোঝা মুশকিল। আমাদের চোখে ওজিল হয়তো অপরাধ করেননি, তবে জার্মানরা তাকে ধোয়া তুলসিপাতা ভাবতে নারাজ, সেটার পেছনে যথাযথ যুক্তিও আছে তাদের। তবে দিনশেষে বাস্তবতা হচ্ছে, জার্মানীর জার্সি গায়ে মেসুত ওজিলকে আর কখনও দেখা যাবে না হয়তো। জার্মানীর হয়ে বিশ্বকাপ জেতা ওজিলের এমন পরিণতি নিশ্চয়ই মন খারাপের কারণ হবে তার অজস্র ভক্তের।

No comments:

Post a Comment