ক্যাপ্টেন আর্মব্যান্ডটা হাত থেকে খুলে ফেললেন, চোখেমুখে তখন আঁধার নেমেছে, সেই আঁধারে মিশে আছে রাজ্যের হতাশা। স্টেডিয়াম আলোয় ভর্তি, সেই আলোর বন্যায় তার হতাশামাখা মুখটা বড্ড করুণ দেখালো। চেষ্টা করেছেন, প্রাণপণে লড়েছেন, তবুও দিনশেষে তিনি পরাজিত দলে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে লিওনেল মেসি টানা তিনটা ফাইনালে হারের যন্ত্রণা সয়েছেন। দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে এবারের বিদায়টা কি এরচেয়েও বেশি যন্ত্রণার? হবে হয়তো। কে জানে, কাতার বিশ্বকাপে তাকে দেখা যাবে কিনা! সোনালী ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরার সর্বশেষ
সুযোগ হয়তো এবারই ছিল!
চার বছর আগে দল ফাইনাল খেলেছিল, তিনিও ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে, হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। গোটজের গোলে ভেঙেছিল স্বপ্ন, তবুও স্বান্তনা তো ছিল, দলকে প্রায় একাই টেনেছিলেন লিওনেল মেসি। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, তিনি ছিলেন নিধিরাম সর্দার। এবার নিজে জ্বলে উঠতে পারলেন না, চার ম্যাচে একটামাত্র গোল তার। দলের অবস্থাও তথৈবচ! গ্রুপপর্বের বাজে পারফরম্যান্স আর দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায়টাই বলে দেয়, এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পারফরম্যান্স কতটা হতাশাজনক ছিল।
হোর্হে সাম্পাওলি কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন বছরখানেক আগে। দল নিয়ে প্রচুর কাঁটাছেড়া করেছেন বিশ্বকাপের আগে। কিন্ত বিশ্বকাপের ম্যাচেও যখন সাম্পাওলির পরীক্ষানীরিক্ষা অব্যহত থাকে, সেটা দলের জন্যে ভালো ফল বয়ে আনার কথা নয়, আনেওনি। সেরা একাদশের দেখা মেলেনি কোন ম্যাচেই! আইসল্যান্ডের মতো দল রুখে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তো ডাহা ফেল মেরেছে সাম্পাওলির ট্যাকটিকস। এমনও শোনা গেছে যে, খেলোয়াড়েরা নাকি সাম্পাওলির ধ্যান ধারণার সাথে নিজেদের মেলাতে পারছেন না! ব্যাপারটা মাঠেও চোখে পড়েছে। আর মেসি-ডিবালা-আগুয়েরোকে একসঙ্গে দেখা যায়নি একটা ম্যাচেও। প্রতিভাবান ডিবালাকে ব্যবহার করতে না পারাটা অবশ্যই দারুণ একটা ব্যর্থতা।
আর্জেন্টিনার এই দলটার বেশীরভার খেলোয়াড়েরই বয়স ত্রিশ বা তার বেশি। তারা অভিজ্ঞ, কিন্ত বেশ কয়েকজনের ফিটনেস নিয়ে আছে প্রশ্ন। মাচেরানোর কথাই ধরুন না। গতবার আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার পেছনে তার দারুণ অবদান ছিল। এবারও তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেছে, ডেডিকেশনে ঘাটতি নেই কোন। কিন্ত বয়স হয়েছে, শরীরের সামর্থ্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। ক্রোয়েশিয়ার সামনে অসহায় হয়ে ছিলেন তিনি, গতকাল ফ্রান্সের দুর্বার তারুণ্যের আগ্রাসী গতির সামনে তাকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
মেসি হয়তো বিশ্বকাপটা জেতার লক্ষ্য নিয়েই এসেছিলেন রাশিয়ায়। কিন্ত বাকীরা? এই প্রশ্নটা উঠবে, কারণ আর্জেন্টিনার খেলা দেখে একবারও মনে হয়নি তারা সেরা দল হবার জন্যে খেলছে। দল হিসেবে আর্জেন্টিনা শেষ কবে খেলেছে সেটা খুঁজতে গেলেও দুই-তিন বছর আগের ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে হবে। এই বিশ্বকাপে তো একটা ম্যাচেও খেলতে পারেনি দল হয়ে। দলের মূল খেলোয়াড় মেসি, অথচ তার কাছে বলই পাস করেন না তারা! ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের আগে সাম্পাওলি বলেছিলেন, তারা মেসির ওপর চাপ কমাতে চান। পরের ম্যাচে মেসির কাছে বলই গেল না, এমন চাপ কমিয়ে কি লাভ হলো?
আর ঐতিহ্যবাহী ডিফেন্স তো আছেই। নামগুলো তো ফেলনা নয়। ওটামেন্দি-মাচেরানো-মার্কোস রোহো- এরা প্রত্যেকেই ভালো খেলোয়াড়। কিন্ত সামর্থ্যের সবটা দিয়ে তারা খেলতে পারলেন কই? ভালো আক্রমণভাগের বিরুদ্ধে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো আর্জেন্টিনার রক্ষণ। ফ্রান্সের গতিশীল ফুটবলের সামনে ঘোল খেয়ে নাকাল হলো। এক এমবাপ্পেই গতি দিয়ে নাচিয়ে ছাড়লেন সবাইকে! এই দলের স্ট্রাইকারদের হয়তো প্রতি ম্যাচেই দুই-তিনটা করে গোল করার সামর্থ্য আছে। কিন্ত ডিফেন্ডারেরাও প্রতি ম্যাচে তিন-চারটা করে গোল হজম করার সামর্থ্য রাখেন।
গোলরক্ষক নিয়ে সমস্যা তো ছিলই। গোলবারের নীচে সার্জিও রোমেরোর অভাবটা অনুভূত হয়েছে প্রচণ্ডভাবে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ ছাড়া মাঝমাঠের দখলও ধরে রাখা যায়নি কোন ম্যাচেই। গতকাল ডি-মারিয়া ঝলক দেখিয়েছেন, জানান দিয়েছেন তিনি ফুরিয়ে যাননি। কিন্ত আগের তিন ম্যাচেই তিনি ছিলেন নিস্প্রভ। গতকাল যেমন তিনি জ্বলে উঠলেও পাশে পাননি তেমন কাউকেই!
আর্জেন্টিনার এই দলটার বিশ্বকাপ মিশন শেষ হলো দ্বিতীয় রাউন্ডে। এর বেশি তাদের জন্যে যাওয়া সম্ভবও ছিল না। এই দলটার মধ্যে মোটিভেশনের প্রচণ্ড অভাব। তারা টানা তিনটে ফাইনাল হেরেছে, জয়ের নেশাটা ফুরিয়ে গেছে কিনা খেলোয়াড়দের ভেতর থেকে, সেটা তারাই ভালো জানবেন। কিন্ত ধ্রুব সত্যি হচ্ছে, আর্জেন্টিনার বিদায়টা অপ্রত্যাশিত নয় মোটেও। এমন বাজে ফুটবলশৈলী প্রদর্শনের পর তো আরও নয়।
তবুও একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করবে লিওনেল মেসির জন্যে। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার যে ছুঁয়ে দেখতে পারলেন না বিশ্বকাপ ট্রফিটা! নিজে ফ্লপ ছিলেন, আর এমন দল, এমন সতীর্থদের নিয়ে যে বিশ্বকাপ জেতা যায় না, সেটা মেসিও নিশ্চয়ই জানেন!
No comments:
Post a Comment