সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেদিন দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন প্রায় আশি হাজার দর্শক। না, কোনো ম্যাচ সেদিন ছিল না। শুধু একটি নাম, তার জার্সি এবং খোদ সেই মানুষটিকেই দেখার জন্য
এতো সমাগম। ফুটবল ও রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিনই ছিল হয়তো। কেননা পঁচিশ বছর আগে গ্রেট দিয়েগো ম্যারাডোনাকে স্বাগতম জানানোর মুহুর্তে নাপোলি’র মাঠে পঁচাত্তর হাজার দর্শক হয়েছিল, সেই রেকর্ডটাও সেদিন ভেঙে গেল। এমন বিশেষ দিন ফুটবল বিশ্বে সবসময় আসে না।
তো যার জন্য এতো আয়োজন, এতো সমাগম, এতো অপেক্ষা…. তিনি হলেন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ডস সান্তোস আভেইরো। ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড থেকে আসা একজন কিংবদন্তী সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সবুজ ঘাসে পা রাখলেন, হাসলেন, হাত নাড়ালেন। পুরো স্টেডিয়াম যেন সমস্বরে উল্লাসে কেপে উঠলো! সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর পর রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাম আলফ্রেডো ডি স্টেফানো তার জার্সিটা উঁচু করে ধরলেন, মাঠজুড়ে করতালির সমাহার। কিছু বললেন তিনি, সবশেষে বললেন ‘আলা মাদ্রিদ’!
শত্রুপক্ষের একক রাজত্ব, আধিপত্য, জয়জয়কার, পরাক্রমশীলতার বিরুদ্ধে তিনি এলেন বিশ্বাস, আশা, শক্তি ও অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে।
নিজ দলের টালমাটাল অবস্থা, সামলিয়ে উঠার কিংবা হাল ধরার কেউ নেই। সদর্পে তিনি এগিয়ে এলেন। দলের আক্রমণভাগকে নেতৃত্ব দিলেন, দলকে টানলেন একাই। না সবসময় তিনি ঠিক পারেননি। ব্যর্থ হয়েছেন অসংখ্যবার, ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে সেটা দলগত হোক কিংবা ব্যক্তিগত! আফসোস করলেন, অনুশোচনায় ভোগলেন, ‘আহা এদের যে আমার কাছ থেকে আরো কিছু প্রাপ্য!’ প্রত্যাশার বারুদ যে চারিদিকে, পারদ সে তো আকাশচুম্বী… বার বার একাই পঞ্চাশ গোল করেও খানিকটা প্রত্যাশার চাপ মেটাতে পারছিলেন, তবে পুরোপুরি না।
না তিনি হারেননি। নিজের কাছে তিনি হারেননি এক মুহুর্তেও। আর যে মানুষ নিজের সাথে নিজে লড়াই করে জিতে যায়, তাকে একেবারে হারিয়ে দেওয়াটা একটু কঠিনই বটে! ‘মাত্র’ বারো বছর বয়সে মাদেইরো থেকে পিতৃমাতৃহীনভাবে লিসবনে চলে যাওয়া এবং সারা কৈশোর দারিদ্র্যতার মতো কঠিনতার সাথে অদম্য লড়াই করে, হার্টের রোগকে হার মানিয়ে যোগ্যতা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করা ছেলেটি… যাকে ‘থিয়েটার অফ ড্রিমস’ এ যোগ দিতে রাজি করানোর লক্ষ্যে সেই থিয়েটারের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ডিরেক্টর স্যার আলেক্স ফার্গুসন নিজেই তার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন।
জর্জ বেস্ট, এরিক ক্যান্টোনা কিংবা ডেভিড বেকহাম এর ‘সাত’ নম্বর জার্সি পড়ে পাহাড়সম চাপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, বল পায়ে তুলেছিলেন উত্তাল শৈল্পিকতার ঢেউ সাথে জন্ম দিয়েছিলেন বিস্ময় ও প্রশংসার সাগরের। দেখলে মনে হতো যেন, মাঠের দুই ফ্ল্যাংক দিয়ে এক প্রজাপতি ছন্দময় গতিতে উড়ছে! এমন অপ্রতিরোধ্য প্রাণকে হারাবে কে! তিনি এমন এক মানুষ যিনি তাকে নিয়ে সকলের ‘ফুরিয়ে যাওয়ার কল্পনা’কে উড়ন্ত বলের মতো এক হেড কিংবা জোড়ালো শট দিয়ে একপ্রান্তে ছিটকে দেন, তৈরি করেন ভিন্ন বাস্তবতার চিত্র! বিদ্রুপ রূপ নেয় মুগ্ধতায়। প্রতিপক্ষের ‘ব্যু’ পরিণত হয় ‘স্ট্যান্ডিং অভেশন’ এ। শত ঘৃণা,অপবাদকে মুছে দেন পায়ের তুলির আঁচড়ে। ইডিট করা চার প্যাকেট শ্যাম্পুর জায়গায়, সত্যিকারের ‘ব্যালন ডি অর’ শোভা পায়।
রোনালদো হেরে যাননি। বরং অনবদ্য কারিশমায় এনে দিয়েছেন দলগত সাফল্য, রিয়াল মাদ্রিদের হ্যাট্রিক ইউরোপ সেরার মুকুট জয়ে তৈরি হয় নতুন ইতিহাস। গত শতাব্দীর সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ফিরে পায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব! যেন প্রমাণিত হয় প্রতিপক্ষ পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে একপক্ষে কেবল রিয়াল মাদ্রিদের নামই উচ্চারিত হতে হবে বারংবার।
শেষ পাচ বছরে চারটি চ্যাম্পিয়নস লীগ। আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের জায়গা যেন এক নিমিষেই শেষ। কিয়েভের ফাইনালে রোনালদোও যেন এক অর্থে বলে বসলেন, ‘কাটানো মুহুর্ত ও সময়গুলো অসাধারণ ছিল।’ হয়তো অনেক হল, আর নয়। সুখস্মৃতি নিয়ে বিদায় নেয়ার বুঝি এখনই সময়। নিজ ঘরে চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফি ঘিরে আনন্দ উদযাপনের মুহুর্তে প্রায় লক্ষ সমর্থক গেয়ে উঠলো, ‘রোনালদো স্টে!’ সাথে যোগ দিয়েছিলেন মার্সেলো, রামোসরাও। তাও বুঝি অভিমান কমলো না।
বোর্ডের সাথে এমুহুর্তে রোনালদোর কি চলছে আমার জানা নেই। ‘প্রফেসনালিজম’ শব্দটার অর্থের গভীরতা বোঝার বয়সও বুঝি আমার হয়নি। পেশাদারিত্ব, মূল্যায়ন, অবমূল্যায়ন আমার কাছে অনেক কঠিন শব্দ! সোজাসাপ্টা কথা, এতো হিসেব নিকেশ আমি বুঝি না। যা বুঝি তা হল, আমি সদ্য কিশোর বয়স পেরিয়ে আসা এক তরুণের কাছে ফুটবল, রিয়াল মাদ্রিদ ও রোনালদো হলো অনুভূতির নাম, মানসিক শান্তির নাম। চূড়ান্ত আবেগ ও ভালোবাসার নাম। সবসময় এক হাতে দুইটা রিসব্যান্ড পড়ে বেড়ায়। একটি রোনালদোর, আরেকটি রিয়াল এর। কেননা আমার কাছে একটি ছাড়া অপরটি অপরিপূর্ণ। আমার কিংবা আমার মতো কোটি মাদ্রিদ ভক্তের কাছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোই এযুগের স্টেফানো, পুসকাস কিংবা রাউল, জিদান, ক্যাসিয়াস!
প্রিয় রোনালদো, সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা তো আপনার। হয়তো সত্যিই চলে যাবেন। হয়তো আমাদের ওপর একদিন ক্ষোভ, অভিমান নিয়ে বলবেন অনেক কথা। অভিযোগ ও অভিমানের তালিকাটা হবে অনেক দীর্ঘ। কথা দিলাম, সেদিন আপনার পক্ষ নিয়ে আমিও অভিমানী হবো, আমিও ক্ষোভের ঝড় তুলবো প্রিয় ক্লাবের বিরুদ্ধে! দীর্ঘ নয়টা বছর সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে যা দিয়ে গেছেন একজন রিয়াল মাদ্রিদ ভক্ত হিসেবে তা নিয়েই চিরঋণী থাকবো, একজন রোনালদো ভক্ত হিসেবে গর্ব করবো।
এতো এতো কথা লেখার পরও সস্তা আবদারটুকুই করি। থেকে যান প্রিয় রোনালদো! সান্তিয়াগো বার্নাব্যু থেকে আপনার ‘প্রস্থান’ এই মন নিতে পারবে না! কি জানি, হয়তো এতটুকু লিখতে লিখতেই আপনার ‘ ‘প্রস্থান’ ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছে।
No comments:
Post a Comment